নারী নেতৃত্ব, নারী সমতা; ন্যায় বিচারে আলিঙ্গন, সমগ্র বিশ্বে গড়ে দেয় বন্ধন
সময়ের পথ পরিক্রমায় নারীর জয়গান থেমে নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ভারত ও জ্যামাইকা থেকে অভিবাসী হয়ে আসা মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন কমলা ডি. হ্যারিস। তিনি প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান যিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে অ্যাডমিরাল লিসা ফ্রানচেত্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন। মার্কিন সিনেটের অনুমোদন পেলে ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী নৌপ্রধান পাবে মার্কিন বাহিনী।
গত বছর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী বিচারপতি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন কেতানজি ব্রাউন জ্যাকসন। মার্কিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের ৫২ তম স্পিকার ছিলেন ন্যান্সি পেলোসি। প্রায় দুই দশক ধরে প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তিনি ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করেন। আরও বেশ কিছু নাম বলা যাবে যাদের সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে চলছে আগামীর পথপানে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নারী সদস্য। অথচ এই শতবর্ষ আগেও যুক্তরাষ্ট্রে নারীর কোনো ভোটাধিকারই ছিল না! ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ১৯তম সংশোধনী গৃহীত হয়, এটা হওয়ার ফলে নারীর ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত হয়। খুব সহজে এটা চলে এসেছে বলার কোন সুযোগ নেই। কেবল বর্ণ বৈষম্য নয়, লিঙ্গ বৈষম্যেও জর্জরিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। নারীর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই স্বীকৃতি দিতে হয়। ভোটদানের অধিকার আদায়, সকল জনগণের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের ভিত্তি তৈরির লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে কারাবরণেরও শিকার হয়েছেন নারীরা। উদ্যমতা ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এই নির্ভীক নারীরা প্রচারণা চালাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন এবং সরকারের কাছে তাদের আবেদন পেশ করেছিলেন। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে নারীর প্রতি জনসমর্থন তৈরি করেছিল, জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯তম সংশোধনীতে মাত্র সাতাশটি শব্দ যা নারীদের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং জাতি হিসাবে আমেরিকার ভাবমূর্তি ও মর্যাদা বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎসাহ-অনুপ্রেরণাই নারীর মূল চালিকা শক্তি। এই শক্তির উপর ভর করে চলছে নারীর অগ্রযাত্রা।
আমেরিকায় নারীর ভোটাধিকার নিয়ে কংগ্রেসে আলোচনা শুরু হয় ১৮৭৮ সালে। এরপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯১৯ সালের ১৯ মে আইনসভার নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এ নারীদের ভোটাধিকারের জন্য সংবিধান সংশোধন বিলটি পাশ হয়। এরপর এটা আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটে উত্থাপিত হয়। উচ্চকক্ষ সিনেট এই সংশোধন বিলটি পাশের জন্য রাজ্যগুলোতে পাঠায়। সংশোধনীটি পাশের জন্য কমপক্ষে ৩৬ টি রাজ্যর সমর্থন দরকার ছিল। অবশেষে ১৯২০ সালে ৩৬ তম রাজ্য হিসেবে টেনেসি বিলটিতে সমর্থন করার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের আগেই শুরু হয়েছিল নারীদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন। ১৮৩০-এর দশকের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাজ্যে কেবল ধনী শ্বেতাঙ্গ পুরুষদেরই ভোটের অধিকার ছিল।
১৮৪৮ সালে নিউইয়র্কে ওমেন’স রাইটস কনভেনশন-এ প্রথমবার নারী সমতা বা নারী সমানাধিকার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। পরবর্তী সময়ে ১৮৯০-এর দশকে, ন্যাশনাল আমেরিকান ওমেন স্যাফারেজ অ্যাসোসিয়েশন এই বিষয়ে সোচ্চার হয়। নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী অধিকার আন্দোলনের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন। ১৯১০ সালে আমেরিকার অন্যান্য রাজ্যগুলো নারীর ভোট দেওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দিতে শুরু করলেও বেশ কয়েকটি রাজ্য নারীর ভোটাধিকার দিতে সম্মত ছিল না। তুমুল আন্দোলন, কঠোর পরিশ্রম ও প্রচারের পর ১৯২০ সালে সফলতা পায় নারীরা।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘নারী সমতা দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা করে। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেস এবং আমেরিকার ৩৭তম রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ আগস্ট দিনটিকে ‘নারী সমতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। আমেরিকায় তখন থেকে এই দিবস উদযাপন শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে নারী সমতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীরা বেশ সফলভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সমগ্র বিশ্ব এখন অবলোকন করছে নারীর দক্ষতা ও যোগ্যতা। করুণা কিংবা কারও দয়ায় নয় বরং নিজগুণে নারী পুরুষদের চেয়ে কোন কাজেই পিছিয়ে নেই। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নারীদের উন্নতি ঈর্ষণীয়। বিশ্বব্যাপী অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন এনে নারীদের সমানভাবে কাজের সুযোগ প্রদান করে চলেছে।
আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে আইনি ও সাংবিধানিক সংশোধন আদায়ের জন্য নারীদেরকে এবং তাঁদের সমর্থকদেরকে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘ নারীদের ভোটাধিকারকে উৎসাহিত করতে থাকে এবং ১৯৮১ সালে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ’ নামক সনদটিতে জাতিসংঘের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নারীর ভোটাধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ন্যায়বিচারে আলিঙ্গন প্রতিপাদ্যে এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তথা বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে নারী সমতা দিবস। ২০০৪ সালে নারী সমতা দিবসে মার্কিন ৪৩তম রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। লড়াই-সংগ্রামে অর্জিত ভোটাধিকার সুরক্ষা কিংবা এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও নারীর কাঁধে। ক্লান্ত নয় বরং অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত সোচ্চার নারীর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর।
♦হাজেরা পারভীন সহ-সম্পাদক, বাংলা সংবাদ