মতামত

জলবায়ু পরিবর্তন ও সংকটাপন্ন বিশ্ব

বিশ্বব্যাপী মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় সংকট এখন জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উঞ্চায়নের কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রমেই বেশি করে ডুবছে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল। বাড়ছে জলবায়ু উদ্বস্তুর সংখ্যা। এই অবস্থায় বৈশ্বিক উদ্যোগ আরো জোরদার করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে বৈশ্বিক উদ্যোগ যেমন কম, সেসবের বাস্তবায়ন আরো হতাশাজনক।

তবে যুদ্ধ মহামারি শুধু মানুষের জীবনকেই বিপন্ন করে না। অনেক কিছুই বদলে দেয়। সভ্যতার নিকট ইতিহাসেই আমরা এমন দেখেছি। স্প্যানিশ ফ্লু পরবর্তী পালটে যাওয়া বিশ্ব, বিপন্ন মানুষের উঠে দাঁড়ানোর ইতিহাস আমাদের জানা। গত শতাব্দীতে দুই দুই বিশ্বযুদ্ধ আমাদের গোটা পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিয়েছে। সমাজ, পরিবেশ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এনেছে। ২০০১সালের ১১ সেপ্টেম্বরের নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল আমেরিকায়। এর জের ধরে দেশে দেশে যুদ্ধের দামামা বেজেছে। বদলে গেছে বহু দেশের সরকার। মানুষ মরেছে অগনিত।

আমাদের চলমান সময়ে কোভিড-১৯ মহামারি এমন করে বদলে দিয়েছে পরিবেশ ও জলবায়ু এবং মানুষের জীবন। বদলে গেছে কর্মপদ্ধতি। মানুষের আচরণ, বিশ্ব বাস্তবতার এ পরিবর্তন আমাদের চলমান ঘটনা বলেই ঠিক অনুধাবন করতে পারছি না। একসময় ফিরে দেখার অবকাশ হবে, ইতিহাস এ পরিবর্তনের সময়কে কিভাবে চিহ্নিত করবে আমরা জারি না।
বিশ্বের ৮০ লাখের বেশি শিশু এতিম হয়ে গেছে মহামারির কারণে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অভিভাবকহীন শিশুরা সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, শুধু ভারতেই ৩৫ লাখ শিশু তাদের মা-বাবা বা অভিভাবক হারিয়েছে মহামারির সময়। লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক লোরেইন শেইর বলেন, অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ও পরিবেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তবে মা-বাবা ও অভিভাবকহীন অবস্থায় বেড়ে ওঠা শিশুরা মানসিক সুস্থতা নিয়ে কতটা বেড়ে উঠবে, এ নিয়েও উদ্বেগ শুরু হয়েছে।

মহামারি শুধু গত চার বছরেই বিশ্বের সামাল দেয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। এর কারণে বদলে যাওয়া বিশ্বকে কীভাবে সামাল দেয়া হবে বা বিশ্ব এ জলবায়ু পরিবর্তনকে কীভাবে ধারণ করবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার সমূহ কারণ রয়েছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে তীব্র দাবদাহ। অসহ্য গরমে মানুষসহ সব প্রাণীর নাভিশ্বাস উঠেছে। তীব্র দাবদাহ, দাবানল আর খরায় পড়ছে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল। আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর অবধি আবহাওয়ার এ অস্বাভাবিক আচরণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে প্রাণীজগত। উইরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ আর দাবানল। পুড়ছে ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে মরক্কোতেও দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তীব্র দাবদাহে গত দুই সপ্তাহে ইউরোপে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেবল স্পেন ও পর্তুগালেই মারাগেছে ১ হাজার ১০০ জনের বেশি মানুষ।

ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’- ১৫ জুলাই ২২ বিভিন্ন দেশে তাপ প্রবাহের একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, স্পেনের সেভোল শহরে তাপমাত্রা উঠেছে ৪২.২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে; ইরানের আহভাজ শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এবং চীনের সাংহাই শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৭.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। আর মধ্যপ্রাচ্যেও বেশিরভাগ বড় শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে।

তীব্র দাবদাহে ব্রিটেনে জাতীয় অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে এমন পূর্বাভাসের পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত কয়েক যুগের মধ্যে ভয়াবহ তাপদাহ ও খরায় পুড়ছে পূর্ব আফ্রিকা। এই খরা গত বছর শুরু হয়ে এখনো চলছে। চার মৌসুম পরও সেখানে বৃষ্টির দেখা নেই। এ অঞ্চলের প্রায় ২ কোটি মানুষ চরম অনাহারে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছে, ভারত মহাসাগরের স্রোতের সঙ্গে সম্পর্কিত বসন্তকালীন বৃষ্টি এ অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই সমুদ্রে ঝড়ে পড়েছে, যার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না ভূমি অঞ্চলে।

তাছাড়া পরিবেশ ও বায়ুদূষণে বিশ্বের সব শহরকে পেছনে ফেলে দূষণে শীর্ষে চলে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ দুপুরে এই প্রতিবেদন লেখার সময়েও দূষণে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল শহরটি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এয়ার ভিজুয়ালের তথ্যানুসারে, গত ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ সকাল পৌনে ৯ টায় ঢাকার বায়ুদূষনের মাত্রা ছিল ২৩৭ পিএম। একই সময় ২৩৬ পিএম নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোর।
বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্টভিত্তিক এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্যানুযায়ী ১৯৭ পিএম নিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল তৃতীয়, ১৯১ পিএম নিয়ে পাকিস্তানের লাহোর চতুর্থ, ১৮৩ পিএম নিয়ে চীনের চেংদু পঞ্চম এবং ১৮২ পিএম নিয়ে ষষ্ঠ ছিল ভারতের রাজধানী দিল্লী শহর।

২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধোয়া। সবাই জানে কীভাবে এ শহরে দুষণ বাড়ছে, অথচ দূষণরোধে কঠোর বিধিমালা থেকেও তা অকার্যকর হয়ে আছে। বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয় গত বছর বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ প্রণয়ণ করে, এতে জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে কিন্তু এর কার্যকারিতা চোখে দেখবেন না। তবে মনে রাখতে হবে, সব দোষ কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একার নয়। (চলবে..)

♦ম আমিনুল হক চুন্নু পিএইচ ডি ফেলো, নিউউয়র্ক

Back to top button